
ইংরেজি ২০১৭ বছর শেষে বেঁচে যাওয়া কিছু ছুটি কোথায় কাটাবো সে নিয়ে বেশ কিছু পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ার পর শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলাম গন্তব্য উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার দেশ – ইথিওপিয়া। এ নিয়ে বেশ কয়েকজন বন্ধু, এমন কি ইথিওপিয়া ভ্রমণ সময়কালে স্থানীয় এবং অন্যান্য পর্যটকরা ও জিজ্ঞেস করেছেন – এত দেশ থাকতে ইথিওপিয়া কেন?
ইউরোপ, আমেরিকা বাদ দিয়ে আফ্রিকা! তাও আবার এই দূর্ভিক্ষ ও খরা পীড়িত ভূমি!
এখানে সিদ্ধান্ত নিতে যে বিষয়গুলো সাহায্য করেছে সেগুলো একটু বলে রাখি – নিরাপত্তা – শেষ ছুটিগুলো সদ্ব্যবহারের জন্য আফ্রিকা যখন বেছে নিয়েছিলাম তখন বিভিন্ন ভ্রমণ বিষয়ক সাইট ঘেঁটে চারটি দেশ পেলাম যেগুলো নিরাপত্তার দিক থেকে চলনসই – নামিবিয়া, বতসোয়ানা, তানজানিয়া আর ইথিওপিয়া।
নিরাপত্তা বিষয়টা যদিও আপেক্ষিক, ভিনদেশীদের কাছে যখন একটি স্থান অনিরাপদ, ঠিক তখনই দেখা যাবে স্থানীয়দের কাছে ঐ একই স্থান পুরোপুরি নিরাপদ। ভ্রমণপিপাসু হওয়ার কারণে অনেক দেশভ্রমণে গিয়েই বিপত্তির স্বীকার হতে হয়েছে একা কিংবা পরিবারসহ। সেই অভিজ্ঞতাগুলো আমাদের ভীত করে নি বরং মানুষের প্রতি বিশ্বাস বাড়িয়েছে। সে গল্প আরেকদিন। তবে নিরাপত্তা বিষয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হল পরিস্থিতির জন্য সচেতন থাকা, আগে থেকে নিরাপত্তা হুমকি সমূহ জেনে প্রাথমিক প্রস্ততি নিয়ে রাখা।
দূরত্ব, ভিসা ও সময় স্বল্পতা – নামিবিয়া, বতসোয়ানা আফ্রিকার দক্ষিণ প্রান্তের দেশ। তদুপরি তাদের কোন দূতাবাস নেই ইউ এ ই তে যেখানে আমি বাস করি। তানজানিয়া মধ্য আফ্রিকায়। এদের দূতাবাসে যোগাযোগ করে জানলাম, বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবে ভিসা পেতে অন্তত এক মাস সময় লেগে যাবে। অন্যদিকে ইথিওপিয়া মাত্র তিন ঘণ্টা ফ্লাইট দূরত্বে অবস্থিত যার ভিসা পেতে লাগে মাত্র এক দিন।
দর্শনীয় স্থান – ইথিওপিয়া নিয়ে খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে দেখা পেলাম এমন অসাধারণ একটি স্থানের যা ইথিওপিয়াকে ভ্রমণ অবশ্যম্ভাবী করে তুলল। স্থানটি হল “ডানাকিল ডিপ্রেশন”। এ নিয়ে দ্বিতীয় পর্বে বর্ণনা থাকবে। এখানে ছোট করে বলে রাখি, ডানাকিল ডিপ্রেশন আগ্নেয়গিরি, সালফার স্প্রিং, লবণ হ্রদ সব মিলিয়ে দর্শনীয় এমন উপযোগ যা বিশ্বের আর কোথাও একসাথে পাওয়া সম্ভব না।
ডানাকিল ছাড়াও আর যে সব কারণে ইথিওপিয়া গুরুত্বপূর্ণ তা হল –
• মানবজাতির বিবর্তনের প্রাচীন কঙ্কাল তথা প্রথম দিককার মানুষের চিহ্ন উদ্ধার হয়েছে এখানে। অনুমান করা হয় এখান থেকেই আদিম বিবর্তিত উন্নত মানুষ ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী। প্রাচীনতম হোমিনিড ‘লুসি’ আবিষ্কৃত হয় ১৯৭৪ এ যা ৩.২ মিলিয়ন বছরের পুরনো।
• লালিবেলা – এ শহরকে বলা হয় দ্বিতীয় জেরুজালেম। ১৯৭৮ এ ইউনেস্কো হেরিটেজ এ স্বীকৃতি পাওয়া এ শহরে রয়েছে মনোলিথিক (একটি পাথর কেটে কেটে তৈরী করা) চার্চগুচ্ছ।
• সেবা’র রাণী কিংবা সাবাহ্’র রাণী কে ঘিরে যে কিংবদন্তী বর্ণিত হয়েছে বাইবেল, কুরআন এবং ইহুদী ইতিহাসে তার শহর হিসেবে ইথিওপিয়ার আক্সুম কে বিশ্বাস করে ইথিওপিয়ানরা; যদিও তা মানতে নারাজ ইয়েমেনিরা। ইয়েমেনিদের বর্ণনা অনুযায়ী সেবা সাম্রাজ্যের অবস্থান ইয়েমেন এ।
বুক অফ এক্সোডাস এ বর্ণিত স্বর্ণ মণ্ডিত কাঠের “আর্ক অফ দ্য কোভেনেন্ট” ইথিওপিয়ানদের দাবী অনুযায়ী আক্সুম শহরের একটি চার্চে কাছাকাছি প্রহরারত অবস্থায় লুকায়িত যদিও এ প্রসঙ্গে ইহুদীদের দাবী এ আর্ক লুকানো আছে জেরুজালেমেই।
• ইথিওপিয়া আরও যে কারণগুলোতে ২০১৫ – সি এন এন এ লিস্টে বিশ্বের সেরা গন্তব্যে উঠে এসেছে এবং দিনকে দিন জনপ্রিয় হচ্ছে সেগুলো হল –◦ জাতিগত বৈচিত্র◦ সুস্বাদু রান্না◦ আদিবাসী◦ সিমিয়েন পর্বতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য◦ কফি – প্রথম আবিষ্কৃত স্থানইথিওপিয়ায় আমার সর্বমোট ভ্রমণ ছিল দশ দিন – ২৩ নভেম্বর থেকে ৩ ডিসেম্বর, ২০১৭।
কিছু বিষয় ইথিওপিয়া ভ্রমণে আগ্রহীদের জ্ঞাতার্থে বলি –• ইথিওপিয়ার মূল এয়ারলাইন্স সরকারি ‘ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্স’। আভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সের ভাড়া এক তৃতীয়াংশে নেমে আসে যদি কেউ আন্তর্জাতিক ফ্লাইটটি ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সের মাধ্যমে করেন। অর্থাৎ আপনি অন্য যে দেশ থেকে ইথিওপিয়া আসবেন, সেই ফ্লাইটটি যদি ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সে ভ্রমণ করেন তবে এরপর ইথিওপিয়ায় আভ্যন্তরীণ ভ্রমণের ক্ষেত্রে আপনি একই এয়ারলাইন্সে ভাড়া দেবেন তিন ভাগের এক ভাগেরও কম যা অত্যন্ত সাশ্রয়ী।
সড়কপথে ইথিওপিয়ায় আভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা মোটামুটি। কিছু কিছু স্থানে বেশ খারাপ। আয়তনে বড় আকারের দেশ হওয়ার কারণে এবং পাহাড়ি ওঠা নামা আর সর্পিল পথে এক শহর থেকে অন্য শহরে যেতে সময় লাগে অনেক। সময় স্বল্পতা কোন সমস্যা না হলে সড়কপথে ভ্রমণ আনন্দদায়ক। কিন্ত যথেষ্ট সময় না থাকলে আভ্যন্তরীণ ফ্লাইট ছাড়া গতি নেই। সেক্ষেত্রে ভ্রমণ ছক কাটার আগে আভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট এর দিনক্ষণ ভালো করে বুঝে নেয়া প্রয়োজন কারণ আভ্যন্তরীণ ফ্লাইট খানিকটা অপ্রতুল।
ভ্রমণ পূর্বে ম্যালেরিয়া / ইয়েলো ফিভার ভ্যাকসিন নিয়ে নেয়া ভালো। না নিয়ে থাকলে যথাযথ সাবধানতা তথা – মশা বিতাড়ক ক্রিম, ভাঁজ করা যায় এমন মশারি সাথে নিয়ে নেয়া উত্তম। দুর্ভাগ্যবশত আমার জানা ছিল না যে ভ্যাকসিন নিতে হয় ভ্রমণের অন্তত দশ দিন আগে। তা না হলে এর কার্যকারিতা থাকে না।
আমি ডাক্তারের কাছে যাই ভ্রমণের একদিন আগে এবং ভ্যাকসিন নেয়া আমার হয় নি। সাথে একটা মশারি নিয়েছিলাম কিন্ত একদিনের জন্যও তা ব্যবহার করা হয়ে ওঠে নি। আমার দশ দিন ভ্রমণের দু-রাত কেটেছে পুরোপুরি খোলা আকাশের নিচে, মাথার ওপর কোন ছাউনি ছাড়া। একরাত কেটেছে তাঁবুতে। আমার অভিজ্ঞতা বলে অতটা শংকিত হওয়ার কিছু নেই তবে সাবধানের মার নেই এটাও সত্যি।
• যারা এডভেঞ্চার প্রেমি এবং জনপ্রিয় পর্যটন স্পট ডানাকিল কিংবা সিমিয়েন পর্বতে যেতে চান, এ দুটো স্থানেই নিরাপত্তা রক্ষী সাথে নিয়ে যেতে হয়। ট্যুর অপারেটররাই সব ব্যবস্থা করে দেয় তবে কথা হচ্ছে এই যে, নিরাপত্তার ব্যপারটাকে এখানে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। আমার ভ্রমণকালে কোন ধরণের বিপত্তির স্বীকার হই নি সত্য তবে ডানাকিল এর “এরতা এলে” আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ থেকে ফেরার পথে আমাদের গ্রুপ ভ্রমণের ঠিক দু’দিন পরের গ্রুপটিই আক্রমণের স্বীকার হয় এবং একজন স্থানীয় গাইড ও একজন জার্মান পর্যটক প্রাণ হারায়।
• ডানাকিল, সিমিয়েন পর্বত, টাইগ্রে এলাকায় পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে দুর্গম প্রাচীন সেমি-মনোলিথিক চার্চে ভ্রমণে যেতে শারীরিকভাবে মোটামুটি ফিটনেস থাকতে হবে। উচ্চতাভীতি, আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ ঘিরে বাতাসে গ্যাসের গন্ধজনিত অসুস্থতা কিংবা ভীতি ইত্যাদি মুক্ত হতে হবে। তা নইলে এই স্থানগুলো এড়িয়ে যাওয়াই উত্তম।
২৩ শে নভেম্বর বৃহস্পতিবার বিকেলের ফ্লাইটে দুবাই হয়ে রাজধানী আদ্দিস আবাবায় নামি সন্ধ্যায়। এয়ারপোর্ট এ নামার আগে আমারও ধারণা ছিল এ দেশে ক’জনই বা আসে বেড়াতে। কিন্ত ইমিগ্রেশনে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখলাম অন্তত ষাট শতাংশই ভিনদেশি। এরপর ইথিওপিয়ায় আমার আরও চারবার আভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে ভ্রমণ করার সুযোগ হয়েছে এবং দেখি প্রতিটি ফ্লাইটের বড় অংশই ভিনদেশি। দীর্ঘ দু’ঘন্টা ইমিগ্রেশনে লাইন শেষ করে, লাগেজ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসি।
নির্দিষ্ট ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে দাঁড়াতেই ডিউটিরত একজন জিজ্ঞেস করে কোথায় যাব। হস্টেল এর নাম বলতেই হাতে ধরা একটা লিস্ট দেখে ঠিকানা খুঁজে সিরিয়ালে দাঁড়ানো ট্যাক্সিচালককে বুঝিয়ে দিল। আমি অফলাইন ম্যাপ চালু করে গন্তব্যের পথে ঠিকঠাক আছে কি না দেখতে থাকলাম। ট্যাক্সি এসে “মিঃ মার্টিন্স কোজি প্লেস” এ এসে থামলে ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে এল দুটো বেওয়ারিশ কুকুর।
হস্টেল এর ম্যানেজার একজন তরুণী। কাগজ সই করে, হস্টেল ভাড়া মিটিয়ে বসে ওয়াইফাই এ সার্ফ করতে করতে তার সাথে গল্প জুড়ে দিলাম। ইথিওপিয়ার নরনারী নির্বিশেষে সবারই দারুণ পেটানো অবয়ব। এখানে রাস্তায় নামলেই দেখা যায় দলে দলে সবাই হেঁটে গন্তব্যের পথে চলেছে। শহর কিংবা মফঃস্বল সব জায়গার চিত্র এক। এমনকি হাইওয়ে ধরেও অনেককে দূর দূরান্তের পথে হেঁটে পথ চলতে দেখা যায়। এর কারণ দারিদ্র।
কিন্ত এই পাহাড়ি ভৌগলিক গঠনে উঁচু নিচু রাস্তায় পথ হাঁটতে গিয়েই এদের শারীরিক গঠন দারুণ এথলেটিক। অলিম্পিকেও এদের প্রায় সব মেডেল দৌড় প্রতিযোগিতায়। ম্যানেজারের সাথে কথা বলে জানলাম সে মুসলিম এবং এ দেশের এক তৃতীয়াংশ তাই। এখানে খৃস্টান সংখ্যাধিক্য। রয়েছে জিউস এবং প্রাচীন পুরনো ধর্ম বিশ্বাসীরাও। প্রত্যেকের মধ্যে রয়েছে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক।
মুসলিম, খৃস্টান ও জিউসদের মধ্যে রয়েছে অবাধ বিবাহবন্ধনের রেওয়াজ। ওর পরিবারেই আছে অন্য ধর্মাবলম্বী সদস্য। পোশাক পরিচ্ছদেও এদের সহজে আলাদা করা যায় না। খুব অল্পসংখ্যক নারীই পর্দাপ্রথা মেনে চলে। একই বক্তব্য পাই পরেরদিন এক ট্যাক্সিড্রাইভারের সাথে আলাপচারিতায়। আক্ষেপ করে তাকে বলি, এমন সম্পর্ক একসময় আমাদেরও ছিল কিন্ত গত এক যুগে সব কেমন বদলে যাচ্ছে। ধর্মীয় মেরুকরণ, অসহিষ্ণুতা দিনকে দিন জায়গা করে নিচ্ছে শান্তিপূর্ণ সহবাসের।
এ বিপুল মহাবিশ্বের হাজার কোটি গ্যালাক্সির একটির প্রায় শেষ প্রান্তের ক্ষুদ্র সৌরজগতের অতীব নগণ্য গ্রহচারী আমরা। অন্য সমস্ত প্রাণী, উদ্ভিদ, জলবায়ু আর প্রকৃতি মিলে গড়ে ওঠা এক খাদ্যজালের কর্তৃত্বময় অবস্থানের এক সদস্য। মহাকালের বিচারে আমাদের তথা মানুষের ইতিহাস মহাসাগরে বিন্দুর ন্যায়। সেই আমরাই মানুষ পরিচয়ের উপরে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ইত্যাদি নানা পরিচয়ে ভাগ হয়ে, হিংসা-হানাহানিতে লিপ্ত হই, যুদ্ধ করি। ধ্বংস করি আমাদের বাস্তসংস্থান। শুধু নিজেদেরই না, প্রতিনিয়ত আমরা হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভূমি, এ গ্রহের বুকে বিচরণ করা সমস্ত জীবের অস্তিত্ব। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র এগুলো এমন লুকনো ভয়ংকর পরিচয় যে কঠিন সময়ে এগুলোই আমাদের বৃহৎ পরিচয় ছাপিয়ে বৃহত্তর হয়ে ওঠে।
হস্টেল এ সকালের নাস্তা সেরে বেরিয়ে পড়লাম প্রথম দিনের আবিসিনিয়ার রাস্তায়। ইথিওপিয়া আরব লেখকদের লেখায় আবিসিনিয়া নামে পরিচিত হয়েছিল বহির্বিশ্বের কাছে উনিশ শতকের প্রথমদিক পর্যন্ত। আদ্দিস আবাবা শহরটিকে তুলনা করা চলে আমাদের চট্টগ্রাম শহরের বছর দশেক আগের অবস্থার সাথে। একটা শান্ত সুন্দর শহরজুড়ে নির্মাণ কর্মযজ্ঞ শুরুর সময়কালে যেরকম দেখাতো অনেকটা সেরকম। দুহাজার সালে যে দেশ ছিল বিশ্বের তৃতীয় গরীব দেশ সে দেশই হয়ে গেল পরবর্তী ১৬ বছরে তৃতীয় দ্রুততম জিডিপি বৃদ্ধির দেশ।
উন্নয়নের পথ ধরে আসে উন্নয়নমূলক কার্যক্রম, বাড়ে জলবায়ু দূষণ। আদ্দিস আবাবার পথে ঘুরতে সেরকমটাই লাগলো। এখনো এর শান্তি শান্তি একটা ভাব আছে। গাড়িঘোড়ার চাপ মোটামুটি। কিন্ত আর কিছুদিন পর যথাযথ পরিকল্পনা না থাকলে আমাদের শহরগুলোর মতো জ্যাম, দূষণ আর অপরিকল্পিত উন্নয়নযজ্ঞে অসহনীয় হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। আমার প্রথমদিনের লিস্টে ছিল –• এক্সচেঞ্জ হাউজ থেকে মুদ্রা বদল• স্থানীয় মোবাইল সিম নেয়া• তিনটি জাদুঘর দেখা –◦ Ethnological museum◦
National museum of Ethiopia◦
Red Terror Martyrs Memorial Museum
হস্টেল ছেড়ে প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটে বাসস্ট্যান্ডে আসলাম। শহরের পথে সবচাইতে সাশ্রয়ী বাহন পুরনো মাইক্রোবাস সার্ভিস। যে দূরত্ব প্রাইভেট ট্যাক্সিতে যেতে লাগে দুশো বির (ইথিওপিয়ান মূদ্রা), সে একই দূরত্ব মাইক্রো সার্ভিসে দু বির মাত্র। এছাড়া এখানে আছে টুকটুক যা আমরা বেবি ট্যাক্সি নামে চিনি আর আছে ঘোড়ার গাড়ি। শহর এলাকার রুটের একটা মাইক্রোবাসে উঠে পড়ে প্রায় চার কিলোমিটার দূরত্বে একটি বাজার এলাকায় এসে নামলাম। ব্যাংক থেকে মুদ্রা পরিবর্তন করে সিম তুলতে তুলতে দুপুর গড়িয়ে গেল। বিশেষত সিম তুলতেই অপেক্ষা করতে হল প্রায় দুঘণ্টা। প্রসঙ্গত বলে নেই, ইথিওপিয়ায় নেটওয়ার্ক কাভারেজ অনেক এলাকাতেই নেই আর ইন্টারনেট গতি কচ্ছপ সদৃশ সে যত প্রাইম এরিয়াতেই ব্যবহার করা হউক না কেন। সময় স্বল্পতায় ট্যাক্সি নিয়ে ছুটলাম ১ম গন্তব্যে।
আদ্দিস আবাবা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থিত এর জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর। দালানটি পূর্বে সম্রাট হাইলি সেলাসি’র (১৯৩০-১৯৭৪ পর্যন্ত ইথিওপিয়ার শাসক যিনি আধুনিক ইথিওপিয়ার স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে পরিচিত) প্রাসাদ ছিল। ঢুকতে টিকিটের দাম ইথিওপিয়ানদের জন্য ৩ বির যা বিদেশীদের জন্য ১০০ ইথিওপিয়ান বির। স্থানীয়ভাবে ভিনদেশীদের অনেকে বলে ফারাঞ্জি আর এই অতিরিক্ত দামকে ভিনদেশীরা ফারাঞ্জি প্রাইস বলে। ফারাঞ্জি আর আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে একসময়কার বহুল প্রচলিত শব্দ ফিরিঙ্গি এক সূত্রে গাঁথা।
যদিও ফারাঞ্জি বলতে পর্তুগিজদের বোঝানো হত, একসময় তার গণ্ডি পর্তুগিজ ছাড়িয়ে শাদা চামড়ার অনধিকারপ্রবেশকারীদের ডাকা হত। কালো মানুষের দেশে উপনিবেশ স্থাপনকারী শাদাদের এখনো মজা করে অনেকে ফারাঞ্জি ডাকে বিশেষ করে শিশু-কিশোররা। টিকিট কেটে ঢুকার মুখেই আদ্দিস আবাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমসাময়িক সচিত্র ইতিহাস বিধৃত আছে কালানুক্রমিকভাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এফিলিয়েটেড এই জাদুঘর স্থাপিত হয়েছে ১৯৫৫ সালে। এর উদ্দেশ্য ইথিওপিয়ার ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও গবেষণা। ইথিওপিয়ার জাতিতাত্ত্বিক ইতিহাসের তের হাজারের বেশি হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপি, শিল্প, চিত্র, ভাস্কর্য, আনুষ্ঠানিক পোশাক-পরিচ্ছদ, গয়না, অলংকার ইত্যাদি নিয়ে চার তলা বিশিষ্ট জাদুঘর ব্যাপ্তি। ইথিওপিয়ার উপজাতিসমূহের কৃষ্টি, আচার, অনুষ্ঠান সময়ানুযায়ী প্রদর্শিত হয়েছে এক একটি তলায়। প্রতিটি তলা ভিন্ন ভিন্ন বিষয় ঘিরে সাজানো। শুধুমাত্র এ জাদুঘরটি সময় নিয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখলেই পুরো ইথিওপিয়ার জাতিতাত্ত্বিক পরিচিতি সম্পর্কে বেশ ভালো একটা ধারণা নেয়া সম্ভব।
দর্শনার্থীদের নোটবুকে মন্তব্য লিখে জাদুঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। সাধারণত যে কোন পর্যটন স্পটে মন্তব্য লেখার সুযোগ আমি ছাড়ি না। এটা অনেকটা পদচিহ্ন রেখে আসার মত। বেরিয়ে যাবার গেটের মুখোমুখি সামনে পড়বে একটি কৌতূহলোদ্দীপক স্মৃতিস্তম্ভ। প্রাথমিক দৃষ্টিতে এটিকে অবশ্য অসম্পূর্ণ কোন নির্মাণ বলে ভ্রম হয়। ভূমি হতে একটি সিঁড়ি উঠে গেছে উপরদিকে যা কোন গন্তব্যে পৌঁছায় না। এটা ইটালিয়ানদের বসতি সময়কালে ইটালিয়ানদের হাতে তৈরি স্থাপত্য যেখানে প্রতিটি সিঁড়ির ধাপ তাদের এক এক বছরের শাসনামলকে বুঝায়। ইটালিয়ানদের হাত থেকে ভূমি উদ্ধারের পর ইথিওপিয়ানরা একে ভেঙ্গে ফেলে নি, বরং এর মাথায় বসিয়ে দিয়েছে তাদের ইথিওপিয়ান সিংহের মূর্তি (Lion of Judah) যা শক্তি, গর্ব আর আফ্রিকার সার্বভৌমত্বের প্রতীক।
পরবর্তী গন্তব্য ন্যাশনাল মিউজিয়াম। গুগল ম্যাপে হেঁটে গেলে দূরত্ব দেখায় দেড় কিলোমিটার মত। কাজেই হাঁটা শুরু করলাম। এরিমধ্যে স্ত্রীর ফোন এল সুদূর অস্ট্রেলিয়া থেকে। দুজন বিশ্বের দুপ্রান্তের দু মহাদেশ থেকে কুশল বিনিময় আর খোঁজ খবর জেনে নিলাম। কথা বলতে বলতেই পথ শেষ হয়ে গেল। ১০ বির দিয়ে টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম।
৪ নভেম্বর ১৯৭৪, রোববার সকাল। উত্তর ইথিওপিয়ার ইরিত্রিয়া বর্ডার ঘেঁষে আফার ট্রায়াঙ্গলে আয়াশ নদীর উপকূলে একদল মানবজন্ম ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করা নৃবিজ্ঞানী রোজকার মত মাটি খুঁড়ে ফুঁড়ে মানবচিহ্ন খুঁজে ফিরছিলেন। দুঘণ্টা গরম, শুষ্ক আর ধূলাময় সাইটে কাজ করে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে ছেড়ে আসার প্রাক্বালে বিজ্ঞানী জোহানসন কি মনে করে শেষ বারের মত নিজে পরীক্ষা করার জন্য নিচে নেমে গেলেন। তখন তার চোখে পড়ে হাতের হাড়ের এক অংশ। কিছু পর খুলি আর পায়ের কিছু অংশও এদিক ওদিক ছিটিয়ে থাকতে চোখে পড়ে তার। পরবর্তী তিন সপ্তাহ ধরে আবিষ্কৃত কয়েকশত হাড়গোড় মানব ইতিহাস নিয়ে নতুনভাবে বিজ্ঞানীদের ভাবার সুযোগ করে দেয় কারণ এই দেহের খণ্ডাংশগুলো এখনো পর্যন্ত আবিষ্কৃত আদিমতম মানুষের সর্বোৎকৃষ্ট নিদর্শন। প্রাপ্ত হাড়গোড় একত্র করলে তা মানবদেহের চল্লিশ শতাংশের গঠন দাঁড়ায় এবং বিজ্ঞানীদের গবেষণায় তা একটি মাত্র দেহের অংশ হিসেবে প্রমাণিত হয়। এর নাম দেয়া হয় লুসি। এই চল্লিশ শতাংশ হাড়গোড় গবেষণা করে যে সিদ্ধান্তগুলোতে আসে বিজ্ঞানীরা সেগুলো হল.
এটি একজন নারীর দেহাবশেষ• এর উচ্চতা ৩ ফুট ৭ ইঞ্চি• ওজন ২৯ কেজি• লুসির আবির্ভাব ৩.২ মিলিয়ন বছর পূর্বে• সে দেখতে শিম্পাঞ্জি সদৃশ কিন্ত সে পায়ে হেঁটে চলত অর্থাৎ সে মানুষ আর শিম্পাঞ্জির মাঝামাঝি অবস্থার রূপ.
এটা আমাদের মত সাধারণের জন্য আশ্চর্যজনক এবং অবিশ্বাস্যও বটে যে কি করে কিছু হাড়গোড় থেকে এতগুলো সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব কিন্ত নৃবিজ্ঞান নিয়ে যারা পড়েন তারা জানেন এই প্রতিটি তথ্য বের করে আনার জন্য রয়েছে বেশ কিছু বিজ্ঞানসিদ্ধ পদ্ধতি। যারা বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারণা পেতে চান তারা গুগল করে দেখলেই বেশ কিছু সহজবোদ্ধ লেখা পেয়ে যাবেন। তো লুসির আবিষ্কার কেন গুরুত্বপূর্ণ? উত্তর শেষের পয়েন্ট টি। আমাদের পূর্বপুরুষদের উৎপত্তি সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক বিবর্তন ধারণার প্রমাণ হিসেবে দেখা মেলে লুসির। এই লুসির রেপ্লিকাই ডিসপ্লেতে আছে ন্যশনাল মিউজিয়ামে যা দেখার জন্য ভিড় জমায় দেশি বিদেশী আগ্রহীরা। আসল দেহাবশেষগুলো এই মিউজিয়ামেরই বিশেষভাবে তৈরি সেফ এ সংরক্ষিত আছে এবং শুধুমাত্র বিজ্ঞানী ও অনুমোদিত ব্যক্তিগণই এর দেখা পান। জাদুঘরটির নীচতলায় লুসির রেপ্লিকার সাথে আছে আরও কিছু ফসিল, মানব ইতিহাস নিয়ে বেশ কিছু কালানুক্রমিক বর্ণনা চিত্রাঙ্কিত আছে। প্রথম তলায় আছে হস্তশিল্প, ভাস্কর্য, পুরনো ইতিহাস সংশ্লিষ্ট পরিধান, হাজার বছরের পুরনো হস্তলিপি। দ্বিতীয় তলায় আছে সমসাময়িক ও আধুনিক শিল্পকর্ম – ড্রয়িং, ভাস্কর্য, চিত্র ইত্যাদি। দ্বিতীয় তলার কাজগুলো যদিও বেশ আকর্ষণীয় তবুও জাদুঘরের মূল ধারণার সঙ্গে আমার কাছে অসঙ্গতিপূর্ণ মনে হয়েছে।
ন্যাশনাল মিউজিয়াম থেকে বের হয়ে ট্যাক্সিতে চড়ে বসি। গন্তব্য রেড টেরর মিউজিয়াম। এরমধ্যে আমি মোটামুটি ধারণা করে ফেলেছি কতটুকু দূরত্বে ভাড়া কত হতে পারে। সে অনুযায়ী দরকষাকষি করে ট্যাক্সিতে চড়ি। চালক সদালাপী। তার গাড়ির সাইড মিরর নেই, জীর্ণ বসার সিট, স্টিয়ারিং হুইল আর গিয়ার কন্ট্রোলার দেখতে ট্রাকের মত। গাড়ির নাম – লাদা, মডেল ১৯৮৩, তৈরি – রাশিয়ায়। ইথিওপিয়ার সিংহভাগ ট্যাক্সি এই ব্র্যান্ড। এড় প্রথম দেখা পাই আলেকজান্দ্রিয়ায়। সেবার এই গাড়ির নাম শুনে আমার পুত্ররা ফিক করে হেসে ফেলে আর চালক বেচারা অপ্রস্তত হয়ে পড়ে। দু’দেশেই চালকের মুখে জানতে পাই যে এর ইঞ্জিন দারুণ শক্তিশালী। বছরের পর বছর কোন ধরণের যন্ত্রণা দেয়া ছাড়াই সে সেবা দিয়ে যায়।
ইথিওপিয়ায় এই ব্র্যান্ড এর আবির্ভাব এর সাথে সোভিয়েত কম্যুনিজম এর প্রসার কোনভাবে সম্পর্কিত এমন একটা ধারণা করছিলাম। তবে অন্তর্জাল ঘেঁটে সেরকম কোন তথ্য পাই নি। আবার একই যুক্তি ইজিপ্ট এর ক্ষেত্রেও কাজ করে না। খুব সম্ভবত লাদা ব্র্যান্ড নিজগুণেই তার স্থান করে নিয়েছে। ট্যাক্সি গন্তব্যে পৌঁছলে চালক নামানোর আগে সতর্ক করে দেয় যে পকেট সাবধান। একই সাবধান বানী ভ্রমণের আগেই গুগল করে জেনেছিলাম কিন্ত সত্যি বলতে কোথাও এ ধরণের কোন সমস্যায় পড়িনি। সম্ভবত আমার চেহারার সাথে স্থানীয়দের যথেষ্ট মিল থাকাতে আমি তাদের টার্গেট হই নি। দশ দিনের ভ্রমণে অন্তত সাত-আট বারই বিভিন্ন সময় অপরিচিতজনরা এগিয়ে এসে আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে তাদের ভাষায়। আমি চুপচাপ হাসিমুখে ওদের কথা শুনতাম। কিছু পরেই ওরা যখন বুঝত আমি ইথিওপিয়ান না, তখন হেসে চলে যেত।
রেড টেরর মার্টিরস মেমোরিয়াল মিউজিয়াম এর থিম রাজনৈতিক যা আগের দুটো থেকে ভিন্ন। দুর্ভিক্ষের দেশ বলতেই আমরা চিনি ইথিওপিয়া। দীর্ঘমেয়াদী ক্ষরা এর মূল কারণ আর ক্ষরার কারণ বৃষ্টির অভাব। দুর্ভিক্ষের ইতিহাস এর সুপ্রাচীন। দুর্ভিক্ষ নিয়ে রাজনীতিও এর স্থায়িত্ব আর প্রভাব বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। সময় ১৯৭৩-৭৪, দীর্ঘস্থায়ী দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারায় প্রায় দুই লক্ষ মানুষ। ফলস্বরূপ হেইল সেলাসি সাম্রাজ্যের পতন ঘটে সামরিক জান্তার ক্যু তে। এর সাথে সমাপ্তি ঘটে তথাকথিত সলোমন রাজবংশের। সূচনা হয় দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধের। মার্ক্স-লেনিন আদর্শের সামরিক শক্তির একাংশ ‘দার্গ’ নামে আত্মপ্রকাশ করে এবং ক্ষমতায় বসে। ১৯৭৭ এ এর নেতৃত্ব নেয় ‘মেঙ্গিতসু হাইলে মারিয়াম’। সামরিক বাহিনীর বিদ্রোহী গ্রুপ ও অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তিসমূহ একত্রিত হয়ে ইপিআরপি (ইথিওপিয়ান পিপলস রেভ্যুলুশনারি পার্টি) নাম নেয় ও ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে লিপ্ত হয় দার্গ এর বিপক্ষে।
অপরদিকে মার্কিন সমর্থনপুষ্ট সোমালিয়া আক্রমণ করে ইথিওপিয়া। পরবর্তী ১০ বছর দার্গ এই বিপক্ষ শক্তি দমনের উদ্দেশ্যে কঠিন ও নির্দয় অবদমন চালায়। ১৯৭৭-৭৮ এর সময়কাল ছিল সবচাইতে নৃশংস। ১৯৭৭ এর এপ্রিল ১৭। মেঙ্গিতসু জনতার সামনে এক ভাষণে লাল তরলে ভর্তি বোতল ছুঁড়ে মারে (যা সাধারণের ভাষ্যমতে রক্তভর্তি বোতল ছিল) এবং ঘোষণা দেয় এক অভিযানের যার নাম ‘রেড টেরর’। এ অভিযানে প্রতি একজন বিপ্লবী(দার্গ) হত্যার বিপরীতে এক হাজার প্রতিবিপ্লবী(ইপিআরপি) হত্যার ঘোষণা আসে। এরপর কয়েক মাসে ফাঁসি, গুম, হত্যা ও নিপীড়নে বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক নেতাকর্মী সহ প্রাণ হারায় প্রায় দশ হাজার মানুষ। আদ্দিস আবাবার রাস্তায় ছিন্নভিন্ন লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। ১৯৯১ এ ইপিআরডিএফ (ইথিওপিয়ান পিপলস রেভ্যুলুশনারি ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট) আদ্দিস আবাবা দখলে নেয়; পালিয়ে বাঁচে মেঙ্গিতসু। ইথিওপিয়ান আদালতের গণহত্যায় অভিযুক্ত আসামী হিসেবে সে এখনো আছে জিম্বাবুয়ের রাজধানী হারারে তে, প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাম্বের আশ্রিত হিসেবে।
রেড টেরর এর সময়কালকে ধরে রাখতে এবং সে সময় যারা প্রাণ দিয়েছে তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনেই এই মিউজিয়াম। অনেকে অবশ্য একে এন্টি-কম্যুনিস্ট প্রোপাগান্ডা হিসেবে মনে করেন। এর বিভিন্ন রুমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সে সময়কার বিভিন্ন সচিত্র প্রতিবেদন, সংবাদপত্রের কাটিং, কফিন, মৃতদের চিহ্ন। ঢোকার কোন টিকিট নেই তবে বেরোবার পথে আছে ডোনেশন এর বাক্স। এ জাদুঘর সম্পর্কে আগেই জানতাম যে এর একটি রুমে সংরক্ষিত আছে মৃতদের কঙ্কাল, হাড়গোড়, ছিন্নভিন্ন পরিধান। পুরো তলা ঘুরে শেষ করে সে রুমের দেখা পেলাম না। রিসিপশন ডেস্কে এসে জিজ্ঞেস করলাম সে রুম কোথায়। ডেস্কের কর্মী জানতে চাইল সত্যিই সে রুমে যেতে চাই কি না। আমি বললাম হ্যাঁ।
সে সাথে করে নিয়ে অন্ধকার একটি রুমের সামনে দরজা দেখিয়ে চলে গেল। রুমে মৃদু আলো জ্বলছে। আমি ছাড়া দ্বিতীয় কেউ নেই রুমে। ডানদিকের কাঁচে ঘেরা শো-কেসের ভেতর থেকে তাকিয়ে আছে ঠাঁসাঠাসি করে রাখা বহু কঙ্কাল। নিবিড় আগ্রহে দেখি আমি। হা করা ভয়ংকর খুলিগুলো দেখে ভীতি হয় না, বেদনা জাগে। ছিন্ন পরিধানগুলো দেখি, ছোপ ছোপ রক্ত, কফ, মাটি কিংবা বর্জ্যের দাগ। মৃত্যুর আগে কতটা তীব্র কষ্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে এদের আত্মাগুলোর। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-রাজনীতি, কত শত আঙ্গিকে আমরা মানুষরা বিভেদের বশে একে অপরকে শত্রু বানাই, হত্যা করি, যুদ্ধ করি। কত প্রাণ এভাবে অস্বাভাবিক তীব্র কঠিন মৃত্যুর মুখোমুখি হয় প্রতিদিন।
Writer: Makshumul Hoque
To read my other blogs visit: Bengali blog