
কাঠমান্ডুর সকাল। ৫টা ১০ বাজে।এত ঠাণ্ডা যে বাইরে বরফ পরবে অবস্থা। আমার বাস ৬টা ৩০ এ। আমি কাঠমান্ডুর বাস স্ট্যান্ড সোরেখুটা এর পাশেই একটা হোস্টেল এ ছিলাম। ভাড়া ৪০০ নেপালি রুপি আর বাস স্ট্যান্ড এ হেটে যেতে ৫ মিনিট লাগে। ৬টার সময় হোস্টেল থেকে চেক-আউট করে হাটা শুরু করলাম বাস স্ট্যান্ড এর পথে। উদ্যেশ্য পোখারা। পোখারা শহরটা নিয়ে অনেক গল্প আর ভিডিও দেখেছি। সেটাকে বাস্তবে দেখতে যাচ্ছি ভাবতেও বেশ ভাল লাগছে।
আমার বাস ছিল ডিউলাক্স ক্যাটাগরির সাথে আবার ওয়াইফাই আর টয়লেট আছে বাসের ভিতরেই। আমার বাসের টিকেট মুল্য ছিল ৬০০ নেপালি রুপি যা টাকার হিসেবে ৪৪৩ টাকার মত। বেশ সস্তা। কাঠমান্ডু থেকে পোখারা যাবার ২ টি মাধ্যম আছে। বেস্ট ওয়ে হল আকাশ পথে সময় লাগে ৪০ মিনিট, দ্বিতীয় মাধ্যম হল বাস। বাসের মধ্যেও ধরন আছে। লোকাল,ডিউলাক্স আর লাক্সারিয়াস। লোকাল বাস গুলো আমাদের দেশের ঢাকার রাস্তার বাস গুলোর মত হয়। যখন তখন থামাবে। টাকা বাচাতে ভুলেও এই বাসে উঠবেন না। ডিউলাক্স বা লাক্সারিয়াস বাসেই ৮ ঘন্টার মত লাগে পোখারা যেতে আর লোকাল বাসের কথা বাদই দিলাম। ১০০ টাকা বাচাতে আপনি নেপালের কিছু সুন্দর ঘন্টা লোকাল বাসে কাটাবেন কেন?
আকাশ পথে পোখারা যেতে এয়ারলাইন্স এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ১২০ ডলার দেখালেও কাঠমান্ডুতে কয়েক হাজার এজেন্সি আপনার চোখে পড়বে যারা ৮০ ডলারে দিচ্ছে। আর বাসের টিকেট কেনার সময় অবশ্যই বাস স্টেশন এ গিয়ে কাটবেন কারন হোটেল বা ট্রাভেল এজেন্সি সবাই আপনার কাছ থেকে বেশি রাখবে। যাবার সময় ৬০০ রুপি দিলেও আসার সময় কিন্তু আমি ৫০০ রুপিতে এসেছি। এমন অনেককে দেখেছি যারা আমার একই টিকেট ১০০০+ রুপিতেও কিনেছে।
যাইহোক, সকাল ৬.৩০ এর আগেই বাস স্ট্যান্ড এ এসে আমার বাস পেয়ে গেলাম, স্ট্যান্ড এই দাঁড়ানো থাকে খোজা লাগে না বা কাউন্টারেও বসা লাগে না । সব বিদেশি পর্যটক। আমিও ত বিদেশিই নেপালের জন্য এটা ভেবে ভালই লাগল,হাহা।
বাস ছাড়ল ৭টায়। রাস্তা আর বাস দুটোই বেশ ভাল। আমার সিট এর পা রাখার জায়গা বা লেগ্রুম ছিল বেশ বড়। ২ ঘন্টা বাস চলার পর থামল এক পাহাড়ি ক্যাফেটেরিয়ার পাশে। সকালের নাস্তা করার সময় ২০ মিনিট। সবাই খেতে ব্যাস্ত আর আমি পাহাড় দেখি। কোন এক লেখকের ভ্রমন বইতে পড়েছিলাম বাঙ্গালি সমতলের প্রানি উচু মাটির টিলা দেখলেই উৎসাহিত হয়ে যায়। আমার বেলায় এই লাইনটা একদম মিলে যায় ।
যেই ক্যাফেটেরিয়ার পাশে থামিয়েছে সেখানে বাফেট খাবারের ব্যাবস্থা আছে। আমার কোন আইটেম খেতে ইচ্ছে করল না কেন জানি। অনেক ঠাণ্ডা। কি খাব,কি খাব ভাবতে ভাবতে দেখলাম আইক্রিম, এক কাপ আইস্ক্রিম নিয়ে খাওয়া শুরু করলাম।

এবং ,
এত ঠান্ডায় আইক্রিম খাওয়া দেখে আমার সাথে থাকা যাত্রিদের রিয়্যাকশন দেখার মত ছিল, মনে মনে আমাকে কি বলেছে কে জানে।
২০ মিনিট পরে সবাই আবার বাসে উঠলাম। আবার সেই বাস চলা। একটু ঘুম দিলাম বাসের সিটটা হালকা কাত করে। বেশ আরামদায়ক। একটু পরে বাসের কন্ডাকটর ঘুম থেকে উঠিয়ে বল্ল দুপুরের খাবারের জন্য ব্রেক ৩০ মিনিট। সামনের ঐ ক্যাফেটেরিয়া থেকে খেয়ে নিন। যাক ভালই হল আমিও বেশ ক্ষুধার্ত । সকাল থেকে এখনো কিছু খাই নি।
নিচে নেমে দেখি রিসোর্ট টাইপের ক্যাফেটেরিয়া! বসার স্থানটাই একটা ট্যুরিস্ট এট্রাকশন। পাহাড়ের পাশে বিশাল উচুতে। আমি চাওমিন আর হালকা শব্জি নিলাম। এখানে বলে রাখা ভাল নেপালে ৯০% বা তারো বেশি মুরগিই হালাল্ভাবে জবেহ করা হয় না। তাই চিকেন আছে এমন কোন ডিস খাবার আগে ভেবে দেখবেন। আর যাই হোক ঘুরতে গিয়ে আনন্দ করা মানে এই নয় ধার্মিক নীতিমালার বাইরে যাওয়া যাবে।
যাইহোক, খাবার শেষ করে বাসে উঠার আগেই কন্ডাক্টর কে জিজ্ঞেস করলাম, ভাইরে আর কত সময় লাগবে?😒 তিনি বললেন ১ থেকে ১.৫ ঘন্টা। খুশি মনে সিটে গিয়ে বসলাম। শরিরে জোস ফিরে এসেছে খাবার খাওয়ার পরে।
পৌঁছে গেলাম পোখারা।
আমার নেপাল ট্রিপের সব থেকে রোমাঞ্চকর ও সুন্দর অভিজ্ঞতাগুলর শুরু এখান থেকেই।
পোখারা তে একটা জায়গা আছে সারাংকোট নামে। এখানে হাজারো পর্যটক প্রতিদিন সূর্যদয় দেখতে আসে । পাহাড়ের বিশাল উচুতে দাঁড়িয়ে অন্নপূর্ণা মাউন্টেন বেশ ভাল স্পষ্ট ভাবেই দেখা যায়। পোখারা শহর থেকে সারাংকোট এর সূর্যদয় দেখে আসতে গাড়ি ভাড়া আর ঘুরানো বাবদ ২-৩ হাজার নেপালি রুপি পর্যন্ত নেয় ট্রাভেল এজেন্সিগুলো। আমি ভাবলাম সারাংকোট এ ই থাকা যায় কি না । যেই ভাবা সেই কাজ। সারাংকোট এ এক বন্ধুর বাড়িতে হোম স্টে করলাম। হোম স্টে হল কোন এক লোকাল মানুষ বা পরিবারের বাসায় থেকে লোকাল জীবন দেখা এবং চুক্তিমত তাকে কিছু সন্মানি দেওয়া । ক্ষেত্রবিশেষে হোম স্টে ফ্রি ও হতে পারে যদি হোস্ট বা যে আপনাকে রাখবে সে ফ্রিতে রাখতে চায় যেমন টা এই ওয়েবসাইট থেকে করা যায় CouchSurfing থেকে
যাইহোক, বন্ধুর সাথে চুক্তি হল ২ দিনে ৪ হাজার রুপিতে থাকতে দেবে সাথে পোখারা থেকে সারাংকোট ফ্রি গাড়িতে নেবে এবং খাবার ও থাকার জায়গা সাথে আবার ঘুড়িয়েও দেখাবে।
এই প্যাকেজ কোন ট্রাভেল এজেন্সির কাছ থেকে নিলে দিনপ্রতি ৫-৬ হাজার রুপি লাগবে আর আমি ২ হাজার টাকায় থাকছি সাথে লোকাল পরিবারের সাথে নেপালিদের মত থাকার সুযোগ । তাও আবার বন্ধুর বাসা সারাংকোট এর সূর্যদয় ভিউ পয়েন্ট এর সাথেই।
আমিত হেব্বি খুশি।
বাস স্ট্যান্ড এ নেমেই দেখি সে আর তার বাবা আমার জন্য জিপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাস থেকে নামার সাথে সাথেই ফুলের মালা দিয়ে বরন করল। নেপালি ট্রেডিশন হয়তবা এই ফুলের মালা দিয়ে অতিথি বরন করা কারন আমি এয়ারপোর্ট এও এরকম দেখেছি অনেক বিদেশিদের বরন করতে । আমি বেশ অভিভুত হলাম। এই ভালবাসা ও সন্মানের মধ্যে কোন ডিপ্লোমেসি বা মারকেটিং খুজে পেলাম না।
পোখারা থেকে সারাংকোট যাবার জন্য আমাদের জিপ ছাড়ল ।

যেতে ৩০ মিনিটের মত লাগল। যতদুর এলাম শুধু উপরেই উঠছি। মাঝে মাঝে আমার ত ভয় করছিল। যদিও এইগুলো খুবই কমন ব্যাপার। বাসায় গিয়ে পৌছালাম। আমার রুমটা বেশ বড় আর ৩-৪টা কম্বল রাখা। পাহাড়ের বিশাল উচুতে। শীত যে কেমন পড়বে রাত্র হলে এটা এতগুলো কম্বল দেখেই আন্দাজ করে নিলাম। একটু পরে একটা জিনিস আবিষ্কার করলাম তা হল এই রুমে ওয়াইফাই ও আছে তাও আবার ভাল স্পিড। এত উপরে কিভাবে কি করে ইন্টারনেট সংযোগ আনা হয়েছে আমার মাথায় ঢুকল না।বাসায় পৌঁছে গোসল করলাম। গরম পানির ব্যাবস্থা আছে!
গোসল করে বুঝলাম শরিরটা একটু বিশ্রাম চায়। একটা টানা ঘুম দিলাম। উঠলাম রাত ৯ টায়। বাইরে হাড় কাপুনে শীত কিন্তু আমার বন্ধু এসে বল্ল ঐযে দেখ ফায়ারক্যাম্প ওখানে অনেক দেশের পরযটকরা ক্যাম্পিং করে ,গান বাজনা গায় আরো অনেক আনন্দ-ফুরতি করে। যাও গিয়ে দেখে আসো। এত শীতে যেতে মন না চাইলেও গেলাম। সে এক অন্য দুনিয়া। আমার এক ট্রাভেলার বড় ভাই সব সময় বলেন ট্রাভেলারদের জন্যেই দুনিয়া, কথাটা আসলে ওখানে গিয়ে পুরোপুরি অনুধাবন হল। সবাই গান গাইছে , নাচছে, বারবিকিউ পার্টি চলছে। আমাকেও সামিল করল তারা। সেখানে ছিলাম রাত ২ টা অবধি ।
তাদের বিদায় বলে রুমে এসে ঘুম দিলাম। কালকে সকাল ৫ টার মধ্যে পাহাড়ের ঐ উচুতে উঠে সূর্যদয় দেখতে হবে। যত আগে উঠা যায় ততই ভাল ভিউ দেখা যাবে গোটা এলাকার আর অন্নপূর্ণা মাউন্টেন এর ।
সকালে খুব জলদি উঠার প্রয়াসে কোন প্রকার বিলম্ব না করেই ঘুম দিলাম সাথে রিমান্ডার সেট করলাম অনেক গুলো। আমি সাধারণত প্রথম এলারম এই উঠে যাই কিন্তু রিস্ক নেই না তাই অনেক গুলো এলারম সেট করি আর কি।
শুভ রাত্রি,
পর্ব ৫ এ দেখা হচ্ছে।
(চলবে)